আয়ুর্বেদের বস্তুবাদী দর্শন: চরক-সংহিতা ও সুশ্রুত-সংহিতার আলোকে
ভূমিকা
আয়ুর্বেদ, ভারতীয় সংস্কৃতির একটি প্রাচীন ধন, শুধুমাত্র চিকিৎসাশাস্ত্র নয়, একটি জীবনদর্শনও। এর মূল গ্রন্থ, চরক-সংহিতা এবং সুশ্রুত-সংহিতা, প্রাচীন ভারতের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করে। এই গ্রন্থগুলি বস্তুবাদী দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত, যা আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এই ব্লগ পোস্টে আমরা আয়ুর্বেদের বস্তুবাদী দর্শন, চরক ও সুশ্রুত সংহিতার বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি এবং চার্বাক দর্শনের সঙ্গে এর সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব। আমার ইউটিউব চ্যানেল MDJ Blog-এ এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত ভিডিও পাবেন।
চরক-সংহিতা ও সুশ্রুত-সংহিতা: আয়ুর্বেদের ভিত্তি
চরক-সংহিতা এবং সুশ্রুত-সংহিতা আয়ুর্বেদের দুটি প্রধান গ্রন্থ। চরক-সংহিতা মূলত অভ্যন্তরীণ চিকিৎসার উপর গুরুত্ব দেয়, যেখানে সুশ্রুত-সংহিতা শল্যচিকিৎসা বা সার্জারির আকরগ্রন্থ। এই গ্রন্থগুলি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিভিন্ন হাত ঘুরে পরিবর্তিত হয়েছে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, এই গ্রন্থগুলিতে অনেক বিষয় প্রক্ষিপ্ত হয়েছে, যার মধ্যে কিছু আয়ুর্বেদের মূল প্রতিপাদ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তবুও, এই গ্রন্থগুলির অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় যে আয়ুর্বেদের দার্শনিক ভিত্তি বস্তুবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত।
উদ্ধৃতি: “সর্বং দ্রব্যং পঞ্চভৌতিকম্ অস্মিন্ অর্থে; তৎ চেতনাবৎ, অচেতনং চ” (চরক-সংহিতা ১/২৬/১০)
অর্থ: আয়ুর্বেদে সব দ্রব্য পঞ্চভূত দ্বারা গঠিত; কিছু চেতনাযুক্ত, কিছু অচেতন।
এই উক্তি থেকে স্পষ্ট যে আয়ুর্বেদ শুধুমাত্র ভৌতিক দ্রব্যের উপর নির্ভর করে, যা চার্বাক দর্শনের ভূতবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আয়ুর্বেদের বস্তুবাদী নির্দেশক
আয়ুর্বেদের দার্শনিক ভিত্তি বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর প্রধান নির্দেশকগুলি হলো:
১. যুক্তি-ব্যপাশ্রয় ভেষজ
চরক-সংহিতা চিকিৎসাকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে: দৈব-ব্যপাশ্রয় ভেষজ (মন্ত্র, তাগা-তাবিজ ইত্যাদি) এবং যুক্তি-ব্যপাশ্রয় ভেষজ (যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা)। দৈব-ব্যপাশ্রয় ভেষজ অথর্ববেদ-এর সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও, চরক-সংহিতা যুক্তি-ব্যপাশ্রয় ভেষজের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এই পদ্ধতিতে আহার ও ঔষধ হিসেবে দ্রব্যের ব্যবহারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, চরক-সংহিতা ৯১০টি গাছগাছড়া এবং ১৬৫টি জীবজন্তুর রক্ত, মাংস, দুধ ইত্যাদির ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছে। এমনকি শাস্ত্র-নিষিদ্ধ গোমাংসের ব্যবহারও ক্ষয়রোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে।
উদ্ধৃতি: “আহার ঔষধ দ্রব্যান্যাং যোজনা” (চরক-সংহিতা)
অর্থ: আহার ও ঔষধ হিসেবে দ্রব্যের ব্যবহার।
এই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি শাস্ত্রের কঠোর নিয়মকে অগ্রাহ্য করে, যা আয়ুর্বেদের বস্তুবাদী চরিত্রকে তুলে ধরে।
২. ভূতবাদ ও ভূতচৈতন্যবাদ
চরক-সংহিতা স্পষ্টভাবে বলেছে যে সমস্ত দ্রব্য পঞ্চভূত (পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ) দ্বারা গঠিত। চেতনাযুক্ত দ্রব্য বলতে ইন্দ্রিয়যুক্ত দ্রব্য এবং অচেতন বলতে ইন্দ্রিয়হীন দ্রব্য বোঝানো হয়েছে। এই ধারণা চার্বাক দর্শনের ভূতচৈতন্যবাদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
উদ্ধৃতি: “সেন্দ্রিয়ং চেতন, দ্রব্যম্; নিরিন্দ্রিম্ অচেতনম্” (চরক-সংহিতা ১/১/৪৮)
অর্থ: ইন্দ্রিয়যুক্ত দ্রব্য চেতন, ইন্দ্রিয়হীন দ্রব্য অচেতন।
এই দৃষ্টিভঙ্গি অতিপ্রাকৃত শক্তির পরিবর্তে ভৌতিক উপাদানের উপর নির্ভর করে, যা আয়ুর্বেদকে বিজ্ঞানসম্মত করে।
৩. প্রত্যক্ষ-প্রাধান্যবাদ
আয়ুর্বেদ রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপর গুরুত্ব দেয়। চরক-সংহিতা এবং সুশ্রুত-সংহিতা উভয়ই বলে যে, প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, রোগীর শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ, ঔষধের প্রভাব পরীক্ষা এবং ফলাফল বিশ্লেষণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
উদ্ধৃতি: “সম্যক্ উপদিশামঃ সম্যক্ পশ্যামঃ চ ইতি” (চরক-সংহিতা ৩/৩/৩৬)
অর্থ: আমরা সম্যকভাবে পর্যবেক্ষণ করব এবং তার ভিত্তিতে উপদেশ দেব।
সুশ্রুত-সংহিতা শল্যচিকিৎসায় প্রত্যক্ষ জ্ঞানের গুরুত্ব আরও স্পষ্ট করে। এটি শব-ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে শারীরিক গঠন অধ্যয়নের পরামর্শ দেয়, যা প্রাচীন ভারতে ধর্মীয় সংস্কারের বিরুদ্ধে একটি সাহসী পদক্ষেপ ছিল।
উদ্ধৃতি: “প্রত্যক্ষতঃ হি যৎ দৃষ্টং শাস্ত্র-দৃষ্টং চ যৎ ভবেৎ। সমাসতঃ তৎ উভয়ং ভূয়ঃ জ্ঞান-বিবর্ধনম্” (সুশ্রুত-সংহিতা ৩/৫/৫৯-৬০)
অর্থ: প্রত্যক্ষ ও শাস্ত্রীয় জ্ঞান উভয়ই জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়ক।
৪. স্বভাববাদ
আয়ুর্বেদে স্বভাববাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। সুশ্রুত-সংহিতা বলে, কোনো দ্রব্যের গুণ (যেমন গুরু বা লঘু) তার স্বভাবের উপর নির্ভর করে। এই ধারণা চার্বাক দর্শনের স্বভাববাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা অতিপ্রাকৃত কারণের পরিবর্তে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের উপর জোর দেয়।
উদ্ধৃতি: “গুরু-লাঘব-চিন্তা ইয়ং স্বভাবং ন অতিবর্ততে” (সুশ্রুত-সংহিতা ১/৪৬/৪৪৮)
অর্থ: গুরুত্ব ও লঘুত্ব স্বভাবকে অতিক্রম করে না।
চার্বাক দর্শনের সঙ্গে আয়ুর্বেদের সম্পর্ক
চার্বাক দর্শন, যা লোকায়ত দর্শন নামেও পরিচিত, বস্তুবাদ ও প্রত্যক্ষ-প্রাধান্যবাদের উপর জোর দেয়। এটি শাস্ত্রীয় শাসন, অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস এবং বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বিরোধী। আয়ুর্বেদের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি চার্বাক দর্শনের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, চরক-সংহিতা এবং সুশ্রুত-সংহিতা ধর্মীয় সংস্কারের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ও যুক্তি-ভিত্তিক চিকিৎসার উপর গুরুত্ব দেয়। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, আয়ুর্বেদের এই দৃষ্টিভঙ্গি চার্বাকের নাস্তিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত।
আয়ুর্বেদের বিরুদ্ধে শাস্ত্রীয় বিরোধিতা
প্রাচীন ভারতে ধর্মশাস্ত্রের কঠোর নিয়মের মধ্যে আয়ুর্বেদের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। যজুর্বেদ এবং মনুস্মৃতি-র মতো গ্রন্থে চিকিৎসক ও শল্যবিদদের প্রতি বিষোদ্গার লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, যজুর্বেদ-এ অশ্বিদ্বয়কে অপবিত্র বলা হয়েছে কারণ তারা চিকিৎসার জন্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছিলেন। এই বিরোধিতা সত্ত্বেও, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের শাসনকে অগ্রাহ্য করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর জোর দিয়েছে।
আধুনিক প্রেক্ষাপটে আয়ুর্বেদের প্রাসঙ্গিকতা
আজকের দিনে আয়ুর্বেদের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রত্যক্ষ-প্রাধান্যবাদ এবং যুক্তি-ভিত্তিক চিকিৎসা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূল ভিত্তি। আয়ুর্বেদের ঔষধি গাছের ব্যবহার, পুষ্টিগুণ এবং প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি আজও জনপ্রিয়। আরও জানতে আমার ইউটিউব চ্যানেল MDJ Blog-এ ভিজিট করুন।
উপসংহার
চরক-সংহিতা এবং সুশ্রুত-সংহিতা আয়ুর্বেদের বস্তুবাদী দর্শনের প্রমাণ বহন করে। যুক্তি-ব্যপাশ্রয় ভেষজ, ভূতবাদ, প্রত্যক্ষ-প্রাধান্যবাদ এবং স্বভাববাদের মাধ্যমে এটি প্রাচীন ভারতের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করে। চার্বাক দর্শনের স