ন্যায়দর্শনে ঈশ্বর: সৃষ্টি, কর্মফল ও মোক্ষের নিয়ন্ত্রক
ভূমিকা
ন্যায়দর্শন ভারতীয় দর্শনের একটি প্রধান শাখা, যা যুক্তি ও প্রমাণের উপর ভিত্তি করে জ্ঞানতত্ত্ব ও দার্শনিক বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করে। এই দর্শনে ঈশ্বরের ধারণা একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। ন্যায়মতে ঈশ্বর পরমাত্মা, যিনি জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের নিয়ন্ত্রক। এই ব্লগ পোস্টে আমরা ন্যায়দর্শনে ঈশ্বরের স্বরূপ, জগৎ সৃষ্টিতে তাঁর ভূমিকা, কর্মফল নিয়ন্ত্রণ এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আরও তথ্যের জন্য আমার ইউটিউব চ্যানেল MDJ Blog ভিজিট করুন।
ন্যায়দর্শনে ঈশ্বরের ধারণা
ন্যায়দর্শনে ঈশ্বরকে পরমাত্মা হিসেবে বিবrect:চার্বাকের সঙ্গে আয়ুর্বেদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি। চরক-সংহিতা এবং সুশ্রুত-সংহিতা-র বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যক্ষ-প্রাধান্যবাদ ও যুক্তি-ভিত্তিক চিন্তার উপর জোর দিলেও, ন্যায়দর্শন ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও তাঁর সর্বজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। ন্যায়মতে, ঈশ্বর জগতের নিমিত্ত কারণ, অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা, যিনি নিত্য পরমাণু, দেশ, কাল ও আকাশের সাহায্যে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। তবে, তিনি এই নিত্য দ্রব্যগুলির স্রষ্টা নন, বরং একজন কুম্ভকারের মতো উপাদান ব্যবহার করে জগৎ নির্মাণ করেছেন।
উদ্ধৃতি: “নিত্যজ্ঞানাধিকরণত্বং ঈশ্বরত্বম” (তর্কসংগ্রহদীপিকা, অন্নংভট্ট)
অর্থ: ঈশ্বর হলেন নিত্যজ্ঞানের আশ্রয়।
ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান এবং সগুণ। তিনি সুখ-দুঃখাদি ভোগ করেন না, কারণ তাঁর শরীর বা অদৃষ্টের মতো সহকারী কারণের অভাব রয়েছে।
ঈশ্বরের ভূমিকা
ন্যায়দর্শনে ঈশ্বরের তিনটি প্রধান ভূমিকা হলো:
- জগৎ সৃষ্টি: ঈশ্বর পরমাণুর সংযোগ সাধন করে জগৎ সৃষ্টি করেন। তিনি জগতের নিমিত্ত কারণ, কিন্তু উপাদান কারণ (পরমাণু, দেশ, কাল, আকাশ) তাঁর দ্বারা সৃষ্ট নয়।
- কর্মফল নিয়ন্ত্রণ: ঈশ্বর জীবের অদৃষ্ট (সঞ্চিত পাপ-পুণ্য) নিয়ন্ত্রণ করেন এবং কর্ম অনুযায়ী ফল প্রদান করেন।
- মোক্ষের পথ: ঈশ্বরের করুণা ছাড়া জীবাত্মার মুক্তি সম্ভব নয়। তাঁর সর্বজ্ঞতা ও করুণা মোক্ষলাভের পথ প্রশস্ত করে।
উদ্ধৃতি: “তত্র ঈশ্বরঃ সর্বজ্ঞঃ পরমাত্মা এক এব” (তর্কসংগ্রহ)
অর্থ: ঈশ্বর এক, নিত্য এবং সর্বজ্ঞ পরমাত্মা।
ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ
ন্যায়দর্শন ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য চারটি প্রধান যুক্তি উপস্থাপন করে:
১. কার্যকারণ বিষয়ক প্রমাণ
ন্যায়মতে, প্রতিটি কার্যের একটি কারণ থাকে। জগৎ একটি কার্য, তাই এর একটি নিমিত্ত কারণ প্রয়োজন। এই নিমিত্ত কারণ হলেন ঈশ্বর, যিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। জগতের বিচিত্রতা ও জটিলতা একটি চেতন সত্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে।
২. অদৃষ্টভিত্তিক প্রমাণ
জীবের সুখ-দুঃখের তারতম্য ব্যাখ্যা করতে ন্যায়দর্শন কর্মবাদ ও অদৃষ্টের ধারণা প্রবর্তন করে। অদৃষ্ট জড় পদার্থ, তাই এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান সত্তার প্রয়োজন, যিনি ঈশ্বর।
উদাহরণ: কেউ সৎকর্ম করেও দুঃখভোগ করলে, তা পূর্বজন্মের অদৃষ্টের ফল। ঈশ্বর এই অদৃষ্ট নিয়ন্ত্রণ করেন।
৩. বেদ-কর্তারূপে ঈশ্বর প্রমাণ
বেদ অভ্রান্ত ও সর্বজ্ঞানের আকর। এর রচয়িতা সর্বজ্ঞ ঈশ্বর ছাড়া কেউ হতে পারেন না। আয়ুর্বেদ-এর নির্দেশ রোগ নিরাময়ে কার্যকর হওয়ায় বেদের প্রামাণ্য প্রমাণিত হয়। তাই বেদের কর্তা হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়।
৪. শ্রুতি প্রমাণ
বেদ ও উপনিষদে ঈশ্বরের স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। মুণ্ডক উপনিষদ বলে:
উদ্ধৃতি: “যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিদ্ যস্য জ্ঞানময়ং তপঃ” (মুণ্ডক উপনিষদ ১/১/৯)
অর্থ: ঈশ্বর সর্বজ্ঞ ও সর্ববিৎ, যাঁর জ্ঞানই তপস্যা।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ এবং ভগবদ্গীতা-তেও ঈশ্বরের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার ভূমিকা উল্লেখিত। এই শ্রুতিবাক্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে।
ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে আপত্তি ও খণ্ডন
সাংখ্য, মীমাংসা ও জৈন দার্শনিকেরা ন্যায়দর্শনের যুক্তির বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করেছেন। যেমন:
আপত্তি: ঈশ্বর যদি জগৎ সৃষ্টি করেন, তবে তাঁর দেহ থাকা প্রয়োজন, ফলে তিনি অসীম হতে পারেন না।
খণ্ডন: ন্যায়দর্শন বলে, ঈশ্বরের দেহের প্রয়োজন নেই। তাঁর ইচ্ছায় পরমাণু সংযুক্ত হয়ে জগৎ সৃষ্টি করে।আপত্তি: ঈশ্বরের জগৎ সৃষ্টির উদ্দেশ্য থাকলে তিনি সুখ-দুঃখের নিয়ন্ত্রক হতে পারেন না, কারণ জগতে দুঃখ রয়েছে।
খণ্ডন: ঈশ্বর জীবের অদৃষ্ট অনুযায়ী ফল প্রদান করেন। জীবের স্বাধীন ইচ্ছাই সুখ-দুঃখের কারণ।আপত্তি: বেদ ও ঈশ্বরের পরস্পর নির্ভরতায় অন্যোন্যাশ্রয় দোষ।
খণ্ডন: বেদ ঈশ্বরের উৎপত্তির জন্য নয়, জ্ঞপ্তির জন্য নির্ভরশীল। তাই এই দোষ অর্থহীন।
আয়ুর্বেদ ও চার্বাকের সঙ্গে তুলনা
আগের ব্লগ পোস্টে আমরা আয়ুর্বেদের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং চার্বাক দর্শনের প্রত্যক্ষ-প্রাধান্যবাদ নিয়ে আলোচনা করেছি। চার্বাক দর্শন ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে এবং প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপর জোর দেয়। ন্যায়দর্শন এর বিপরীতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও সর্বজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। আয়ুর্বেদ যুক্তি-ব্যপাশ্রয় ভেষজের মাধ্যমে বিজ্ঞানসম্মত হলেও, ন্যায়দর্শন ঈশ্বরকে জগতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে গ্রহণ করে।
উপসংহার
ন্যায়দর্শনে ঈশ্বর হলেন সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান পরমাত্মা, যিনি জগৎ সৃষ্টি, কর্মফল নিয়ন্ত্রণ এবং মোক্ষের পথ প্রদান করেন। কার্যকারণ, অদৃষ্ট, বেদ ও শ্রুতির মাধ্যমে তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। আয়ুর্বেদের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে, ন্যায়দর্শন ঈশ্বরের কেন্দ্রীয় ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করে। আরও জানতে আমার ইউটিউব চ্যানেল MDJ Blog দেখুন।
রেফারেন্স:
- ন্যায়সূত্র, মহর্ষি গৌতম।
- তর্কসংগ্রহদীপিকা, অন্নংভট্ট।
- মুণ্ডক উপনিষদ।
- MDJ Blog YouTube Channel